|

একজন আদর্শ নেতার কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি

 


মনে করুন, মি. মল্লিক পুরান ঢাকার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক । ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে অন্য চাকরি না নিয়ে একটা লেদ মেশিন কারখানায় কাজ শেখার জন্য কর্মজীবন শুরু করেন । পরে অনেক কষ্ট করে নিজেই লেন মেশিন বসিয়ে ধীরে ধীরে এই ফার্ম গড়ে তুলেছেন । 

তার ফার্মে এখন অনেক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও দক্ষ কারিগর কাজ করে । বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি এখানে প্রস্তুত হয় । বিদেশী যন্ত্রপাতি দেশে আসলেই জনাব মল্লিক তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন । উদ্দেশ্য হলো তার আদলে কিছু করা যায় কি না? 

একদিকে ফরমায়েশের ভিত্তিতে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বানানোর কাজ চলে অন্যদিকে নতুন যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ বানিয়ে তা বিপণন করা হয়। সমধর্মী পণ্য তৈরির জন্য আলাদা-আলাদা বিভাগ করে দিয়েছেন। 

বিভাগের দায়িত্ব তিনি এমন ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত করেছেন যারা দক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আন্তরিক । তিনি প্রতিষ্ঠানের সবার প্রয়োজন বোঝেন। তাদের সাথে মেশেন । সমস্যাগুলো নিজে বুঝে সমাধান করতে চেষ্টা করেন । অনেক সময় বিভাগীয় প্রধানদের ওপর সমসা সমাধানের দায়িত্ব দেন। 

যাতে তারা সমস্যা সমাধানে যোগ্যতা অর্জন করে । দক্ষ কারিগর তৈরি ও তাদেরকে ধরে রাখার বিষয়ে তিনি খুবই আন্তরিক । কর্মীদের উন্নতি যেমনি হচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিষ্ঠানেরও উন্নতি ঘটছে । 

এক্ষেত্রে মি. মল্লিক একজন শিল্পোদ্যোক্তা ও শিল্পের নেতা । আলোচনায় তার অনেক গুণ বেরিয়ে এসেছে যা একজন নেতার মধ্যে থাকা প্রয়োজন। 

অবশ্য কাল-পাত্র ও পরিবেশেভেদে গুণের আবশ্যকতার কিছুটা হেরফের হলেও সাধারণভাবে একজন নেতার যে সকল গুণ থাকা আবশ্যক তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

1. শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা (Education and experience) : 

বিদ্যাচর্চা, অভ্যাস চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে সার্জন বা জ্ঞান আয়ত্তকরণকে শিক্ষা বলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানার্জন যেমনি শিক্ষা তেমনি ড্রাইভিং শিক্ষাও শিক্ষা। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একজন মানুষ যা শেখে তাও শিক্ষা হিসেবে গণ্য। আর সকল শিক্ষাই আলো । 

বর্তমানকালে একজন আদর্শ নেতার কাম্যমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয় । এরূপ যোগ্যতা অধস্তনদের মাঝে নেতার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করে । এ ছাড়া শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দায়িত্ব পালনে একজন নেতাকে শক্তি জোগায়।

2. সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা (Organizational Knowledge and skill): 

সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও যোগ্যতার সাথে তা পরিচালনার জ্ঞান ও দক্ষতাকেই সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা বলে। একজন সফল নেতাকে অবশ্যই যোগ্য সংগঠক হওয়া উচিত এজন্য কাজকে বাস্তবতার নিরিখে যথাযথভাবে বিভক্তকরণ, কাজ অনুযায়ী উপযুক্ত কর্মী বাছাই, দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের যথাযথ নিরূপণ ও বণ্টন, সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, কার্যকর সমন্বয় সাধন এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় নেতাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়।



৩. শক্তি ও সামর্থ্য (Power and ability) : 

প্রয়োজনীয় কাজ ও চিন্তা করার মত শারীরিক, মানসিক জ্ঞানগত, কারিগরি ইত্যাদি যোগ্যতাকে নেতার শক্তি ও সামর্থ্য বিবেচনা করা হয়ে থাকে। 

একজন আদর্শ নেতাকে সকল কাজেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন পড়ে কার্যক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা অনেক ময়ই নেতার মাঝে মারাত্মক মানসিক চাপেরও সৃষ্টি করে । 

নেতাকে কার্যত চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ নিয়ে ভাবতে , যে কোনো সময় কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তাই নেতাকে যথেষ্ট দৈহিক ও মানসিক সামর্থ্যের ধিকারী হওয়া আবশ্যক ।


৪. সাহস ও দৃঢ় মনোবল (Courage and strong morale) : 

যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্ভীক বা ভয়হীন কে মানসিক শক্তি সহকারে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়ার গুণকে নেতার সাহস ও দৃঢ় মনোবল হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একজন আদর্শ নেতাকে অবশ্যই সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হতে হয়। নেতা যদি অল্পে ভেঙ্গে পড়েন, ঘাবড়িয়ে যান তবে তার পক্ষে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অনুসারীদের পরিচালনা করা সম্ভব হয় না ।



৫. দায়িত্ব ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা (Mentality of undertaking responsibility and risk) : 

কোনো কর্ম সম্পাদনের বা কর্তব্য পালনের দায়কে দায়িত্ব বলে। অন্যদিকে ঝুঁকি হলো আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা নায়বোধের সাথে ক্ষতি মেনে নেয়ার মানসিকতা নেতার দায়িত্ব ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা হিসেবে গণ্য। একজন নেতা শুধু কর্তৃত্বেরই অধিকারী হন না সকল কাজের দায়-দায়িত্ব ও ঝুঁকি তাকেই গ্রহণ করতে হয় । নেতা যদি অধস্তনদের কাজের দায় নিজের কাধে তুলে নিতে ব্যর্থ হন তবে তার পক্ষে অধস্তনদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য সম্ভব নয়।


৬. ধৈর্য (Patience): 

যে গুণের প্রভাবে বিপদের সময়ও একজন ব্যক্তি অটল থাকতে পারে তাকে ধৈর্য বলে। এটি নেতার একটি অপরিহার্য গুণ। প্রতিকূল পরিবেশে নেতা যদি ধৈর্যের পরিচয় দিতে না পারেন তবে তার পক্ষে অনুসারীদের সঠিক পথে পরিচালনা কখনই সম্ভব হয় না। অধস্তনরাও সব সময় কাঙ্ক্ষিত আচরণ করবে এমনও নয় । সেক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে তা সংশোধনের জন্য নেতাকে উদ্যোগী হতে হয় ।


৭. অধস্তনদের সম্পর্কে জ্ঞান (Knowledge about subordinates) : 

বোধ, বুদ্ধি ও বিবেচনাকে এককথায় জ্ঞান বলে। অধস্তনদের সম্পর্কে এরূপ জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনাকে অধস্তনদের সম্পর্কে জ্ঞান বলে। একজন নেতার কাজ হলো অধস্তনদের সকল প্রচেষ্টাকে লক্ষ্যপানে পরিচালনা করা। 

অধস্তনদের চিন্তা-চেতন আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে নেতার সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে সকল অবস্থায় জনশক্তির আনুগত্য লাভ ও পরিচালন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। 


৮. ন্যায়পরায়ণতা (Justice) :

সকল অবস্থায় অন্যায় পরিহার করে ন্যায় পথে চলা বিশেষত অধস্তনদের পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার গুণকেই ন্যায়পরায়নতা বলে। একজন আদর্শ নেতার অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হওয়া আবশ্যক। 

অধস্তনদের মাঝে যদি তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন বা সবাইকে সমান নজরে দেখতে না পারেন এবং অধস্তনরা যদি ঊর্ধ্বতনকে সৎ ও সবার প্রতি সমান সহমর্মী না ভাবে তবে তার পক্ষে অনুসারীদের আনুগত্য লাভ ও শ্রদ্ধার্জন সম্ভব নয় । 


৯. পরিশ্রম ও কষ্টসহিষ্ণু (Hard work and endurance) : 

শ্রম প্রদান বা মেহনত করাকে পরিশ্রম বলে। অনেক সময়ই নেতাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। কষ্টকর পরিবেশেও তাকে ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যেতে হয় । যে অবস্থায় তাকে যথেষ্ট কষ্টসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। 

তাই নেতা যদি অলস হন, কাজ না করেন, অল্পতেই ভেঙ্গে পড়েন তবে তার পক্ষে অনুসারীদের সঠিক পরিচালনা সম্ভব হয় না। একজন নেতাকে সময়ই স্মরণে রাখতে হয় যে, Industry is the mother of good luck, অর্থাৎ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি ।


১০. যোগাযোগ নৈপুণ্য (Skill in communication) : 

মনের ভাব, তথ্য ও সংবাদ অন্যের নিকট সুন্দরভাবে তুলে ধরে তার বা তাদের নিকট থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যুত্তর প্রাপ্তির সামর্থ্যকেই যোগাযোগ নৈপুণ্য বলে। কার্যকর নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

নেতা যত সহজে ও সুন্দরভাবে তার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, আদেশ-নির্দেশ অধস্তনদের নিকট তুলে ধরতে পারেন দ্রুতই তা বাস্তবায়ন সহজ হয়। একইভাবে অধস্তনদের চিন্তা, কাজ এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও নেতার নিকট সার্বক্ষণিক তথ্য থাকার প্রয়োজন পড়ে। যা যোগাযোগ নৈপুণ্যের মাধ্যমেই একজন নেতা অর্জন করতে পারে।


১১. উৎসাহদানের ক্ষমতা (Power of encouraging) :

অধস্তনরা যাতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কাজ করতে উদ্দীপ্ত হয় তা নিশ্চিত করতে পারার সামর্থ্যকেই নেতার উৎসাহদানের ক্ষমতা বলে। অধস্তনদের কাজের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা নেতার কাজ। 

অনুসারীদের লক্ষ্যপানে সঠিকভাবে পরিচালনা, আনুগত্য লাভ ও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কোনো কর্মীকে কোন অবস্থায় কিভাবে কাজে উদ্দীপ্ত করা যায় এবং উৎসাহ ও উদ্দীপনা ধরে রাখা যায় এ সম্পর্কে নেতার জ্ঞান থাকা আবশ্যক।


১২. দূরদৃষ্টি বা প্রজ্ঞা (Foresightness) : 

অন্তদৃষ্টি দিয়ে কোনো বিষয়ে আগাম চিন্তা করতে পারবে। সামর্থ্যকেই প্রজ্ঞা বলে। একজন নেতাকে অবশ্যই প্রজ্ঞাবান বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। অতীত ও বর্তমানকে বিবেচনা করে তিনি যদি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন তবে তার পক্ষে সাঁক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না । 

একজন নেতা যখন সঠিক পূর্বানুমান করতে সমর্থ হন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেন তখন অধস্তনদের মাঝে নেতার প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post